স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার টেকসই ভিত্তি তৈরি তথা গুণগত মান বৃদ্ধিই একটি শিক্ষিত জাতি বিনির্মাণের অন্যতম পূর্বশর্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষক, অভিভাবক ও কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে। একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি।
শিক্ষা একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। একটি দেশ কতটুকু উন্নত হবে, তার ভবিষ্যৎ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা বোঝা যায় শিক্ষাসংক্রান্ত পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণরুপে শিক্ষাক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা দেখে উপলব্ধি করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সরকার নানাভাবেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিতে ব্যাপক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল সাফল্য। তবে তার টেকসই বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন পদ্ধতি দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির গঠন এবং কমিটির দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর নীতিমালা প্রণয়ন করে। নীতিমালায় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, গঠন পদ্ধতি, কমিটির দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয় এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নিম্নরূপ সদর উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাহিদা পারভীন জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে (এসএমসি) ১. বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক/ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সদস্য সচিব, ২ অভিভাবকদের মধ্য হতে মানোনীত একজন বিদ্যোৎসাহী মহিলা অভিভাবক (নূন্যতম এসএসসি পাস) সদস্য, ৩ অভিভাবকদের মধ্য হতে মনোনীত একজন বিদ্যোৎসাহী পুরুষ অভিভাবক (নূন্যতম এসএসসি পাস) সদস্য, ৪ বিদ্যালয়ের একজন জমিদাতা/জমিদাতার উত্তরাধিকারী সদস্য, ৫ নিকটবর্তী যে কোনো সরকারি/বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক/শিক্ষিকা সদস্য, ৬ শিক্ষক/শিক্ষিকাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত একজন শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য, ৭-৮ অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের মধ্য হতে নির্বাচিত দুজন মহিলা অভিভাবক সদস্য, ৯-১০ অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের মধ্য হতে নির্বাচিত দুজন মহিলা অভিভাবক সদস্য, ১১ ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্য/পৌর এলাকার সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কমিশনার/সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর সদস্য।
প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্ব ও কর্তব্য নাহিদা পারভীন আরো বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনের ওপর প্রতি বছর মে, আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসের ৩০ (ত্রিশ) তারিখের মধ্যে উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারের নিকট নির্ধারিত ছকে কমিটির সদস্য সচিব ও সভাপতির যৌথ স্বাক্ষরে প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। একই সাথে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যয়িত অর্থের হিসাব অনুমোদন করবে। এসএমসি কর্তৃক খরচের বিষয়টি অনুমোদিত না হলে তা অডিটে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা : বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিখন-শেখানো পরিবেশ সম্পর্কিত অবস্থা বিশ্লেষণ এবং সমস্যা চিহ্নিত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। এ ক্ষেত্রে তহবিল সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও তাদের নিকট ন্যস্ত থাকবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিতকরণ : সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এলাকায় বিদ্যালয় গমনোপযোগী সকল শিশুর বিদ্যালয়ে গমন নিশ্চিতকরণ স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে কমিটি অটিস্টিক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু চিহ্নিত করে ভর্তিসহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান, তাদের চাহিদা সম্পর্কে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ এবং রেফারেল সার্ভিস প্রদানে সহযোগিতা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা : প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির পাঠদান কার্য তদারকীকরণ; শিখন-শেখানো সামগ্রী তৈরি/ক্রয়ে সহায়তা প্রদান এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনার জন্য প্রাপ্ত তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ স্কুল ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় প্রাথমিক শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ কার্যক্রমে ক্যাচমেন্ট এলাকার সংশ্লিষ্ট শিশু ও অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষক নির্বাচনে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে শিক্ষক নির্বাচনসহ সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সাব-ক্লাস্টার ট্রেনিং এবং একাডেমিক তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারকে সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। দুর্যোগকালীন সময়ে অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের সতর্কীকরণ, প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ের করণীয় নির্ধারণসহ দুর্যোগকালীন পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য স্কুল ম্যানেজিং কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও শিক্ষক প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য নয়জন সদস্য পর্যায়ক্রমে বিদ্যালয় চলাকালীন সার্বিক পর্যবেক্ষণ, শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি, শিক্ষার মান ও পরিবেশের বিষয়ে রিপোর্ট তৈরি এবং প্রতি মাসে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন। তিনি আরো বলেন, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কিত সুপারিশ করবেন। এর মাঝে বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা ও নৈতিক শিক্ষা প্রদানের বিষয়ে কমিটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘চাইল্ড ইন্টিগ্রিটি ও শিশু বঙ্গবন্ধু ফোরাম’ প্রতিষ্ঠা ও ফোরামের যথাযথ তত্ত্বাবধান করতে পারে। কমিটির সকল সদস্য প্রতি মাসের শেষ কর্মদিবসে বা নিকটবর্তী দিবসের পাঠদান কর্মসূচির পরে অন্তত এক ঘণ্টা ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ/সুপারিশ শ্রবণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। উন্নয়নমূলক কাজ, যেমন বিদ্যালয় গৃহ, রাস্তা নির্মাণ, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখাসহ অন্যান্য কাজে সহযোগিতা প্রদানসহ এ সকল বিভিন্ন সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। শিক্ষার মানোন্নয়নে মা সমাবেশ ও উঠান বৈঠকের আয়োজন। সমাবেশে মতবিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সমস্যা চিহ্নিত, দূরীকরণ ও সংশোধনে ব্যবস্থা গ্রহণ। শিক্ষার্থীরা বাড়িতে নিয়মিত পড়ালেখা এবং ছুটির দিনে সামাজিক ও কল্যানমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে এমন উপদেশ প্রদান করতে পারে। এছাড়া বিদ্যালয় গমনোপযোগী সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি ও নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শিশুদের ঝরে পড়া রোধে ক্যাম্পেইন করতে পারে। বিদ্যালয়ের সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ও পক্ষ, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, ভাষা আন্দোলন দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পুরস্কার বিতরণী, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড-, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি কার্যক্রম আয়োজন ও সম্পাদনে সহযোগিতা প্রদান।
তিনি আরো বলেন, বিদ্যালয়ের সমস্যাবলি নিয়ে জনসাধারণ ও উপজেলা শিক্ষা কমিটির যোগসূত্র স্থাপন ও সমন্বয় সাধন করে বিদ্যালয় সংস্কার ও মেরামতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত, কাজ চলাকালে তদারকি এবং কাজ সম্পন্নের পর সমাপ্তি প্রতিবেদনে ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে কমিটির সদস্য সচিব অর্থাৎ প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর প্রদান নিশ্চিত করতে পারে। শিক্ষক-অভিভাবক সমিতির (পিটিএ) সঙ্গে সংযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারে; যা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
নাহিদা পারভীনের মতে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার পূর্বশর্ত হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ববহ স্তর হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। জাতিসংঘ ঘোষিত (টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট) অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ’-এ সব শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করা এবং মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র কর্মপদ্ধতি উদ্ধৃত রয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। আর প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে পরবর্তী শিক্ষাও ক্রমান্বয়ে মজবুত ভিত্তির ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর এর মাধ্যমে দেশ ও জাতি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হবে উন্নতির অভিমুখে; মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে শির উঁচু করে টিকে থাকতে পারব আমরা। সব হবে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’র আজন্মলালিত স্বপ্ন।