আঁকাবাঁকা পাহাড়ি মেঠোপথে স্কুলে যাওয়া। দুর্গম এ পথ কারো জন্য ঘণ্টা খানেকের, আবার কারো জন্য কয়েক ঘণ্টার। এ চিত্র জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ভারতীয় সীমানা ঘেষা পাহাড়ি জনপদের। ফলে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে রয়েছে ক্ষুদ্র-নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রায় তিন হাজার মানুষ।
নানা প্রতিকূলতার কারণে এ এলাকায় দিন দিন বেড়েই চলছে স্কুলবিমুখ শিক্ষার্থীর সংখ্যা। সেই সাথে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে অসহনীয় দূর্ভোগ পোহাচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ। স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও তাদের জন্য নেই সরকারি তেমন কোনো সুযোগ সুবিধা। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন। জেলা সদর থেকে ৫৫ কিলোমিটার উত্তরে এই পাহাড়ি জনপদে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছে গারো সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার সদস্য । ক্ষুদ্র-নৃ-তাত্বিক এই জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটন ও কাজের সন্ধানে শহরমূখী হওয়ায় তাদের অধিকাংশ শিশু এখন স্কুল বিমুখ। তাই এখনও অনেকটাই অন্ধকারে রয়েছে গারো সম্প্রদায়ের অধিকাংশ পরিবার। চিকিৎসা সেবায় কোনো কার্যক্রম না থাকায় স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা-ঘাটের কোনো কাজ না করায় ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গারো সম্প্রদায়ের মানুষজন। বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের সাতানিপাড়া, সোমনাথপাড়া, দিঘলাকোনা, টিলাপাড়া, বালিঝুড়ি, গারোমারা, হাতিবেরকুনা এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
দিঘলাকোনা গ্রামের বাসিন্দা বিন্দু মারাক বলেন, ক্ষুদ্র-নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর জন্য রয়েছে একটি মাত্র জুনিয়র স্কুল । চিকিৎসার জন্য নেই কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। চলাচলের রাস্তাগুলো গত ৪০ বছরেও কোন উন্নয়ন বা সংস্কার করা হয়নি। একই গ্রামের ষাটোর্ধ পুদি মারাক বলেন, দেশ স্বাধীনের পর কত সরকার এলো-গেলো কিন্তু তাদের দিকে কেউ তাকালো না। এই অঞ্চলের উন্নয়নে আজ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে এলোনা। তাদের দুঃখ দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই।
এ ব্যাপারে দিঘলাকোনা গ্রামের স্যার আন্দ্রে বেসেট্ট জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিশুশ্র শোভা দাস বলেন, তার এই স্কুলে ৪-৫শ’ শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১১০ জন। তবুও মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের উপস্থিতি খুবই কম। দারিদ্রতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ক্ষুদ্র-নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতা ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি পিটিশন সাংমা বলেন-আমাদের গারো উপজাতিরা খুবই কষ্ট করে বসবাস করে। বিলাসিতা দূরে থাক, মৌলিক চাহিদা থেকেও বঞ্চিত এই সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য সরকারের উদ্যোগ গ্রহন করা উচিত। অবহেলিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে এক সময় আদিবাসী শূণ্য হয়ে পড়বে পাহাড়ি এ এলাকা।
দিঘলাকোনা গ্রামের সাধু আন্দ্রে ধর্মপল্লীর ধর্মগুরু ফাদার ডোমিনিক সরকার পিএসসি বলেন-“আধুনিক যুগে যখন বিশে^র সবকিছুই ডিজিটাল। তখন আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের ক্ষুদ্র-নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অসচেতনতা ও দারিদ্রতার কারনে গারো উপজাতির সন্তানদের স্কুলে অংশগ্রহন খুবই কম। এছাড়া এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় চলাফেরায় করা খুবই কষ্টসাধ্য। জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে ব্যস্ত থাকা এই গারো উপজাতির স্বাস্থ্য সম্পর্কেও নেই তেমন কোনো সচেতনতা।
ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান লাকপতি বলেন, উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় গারো উপজাতিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী ও কর্মক্ষম করতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা মুন মুন জাহান লিজা বলেন,স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কমিটি করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের প্রক্রিয়া চলছে। ক্ষুদ্র-নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে সে বিষয়ে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন।