বসন্ত মানে পলাশ শিমুল ফুল। অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি আগুন রাঙ্গা পলাশের রুপ কার না ভালো লাগে। বাংলার মানুষ পলাশকে ঘিরে পশুপাখির কলকালীতে মুগ্ধ হয় । ফাগুনের উত্তাল বাতাসে চোখ জুড়ানো সবুজ বনের মাঝে পলাশ ফুলের হাসি দেখে মনে হয় সবুজের বুকে আগুন লেগেছে । দুর থেকেও মানুষের নজর কাড়ে তাই পলাশ ফুলকে বলা হয় অরণ্যের অগ্নি। কিন্তু বসন্তের এই ফুল এবার ফোটেছে শীতের এই ভরা মাঘে। পলাশ ফুল নিয়ে মায়াময় রুপের বাহার পলাশ ফুলে রয়েছে গান, কবিতা, গল্প। ভারতীয় উপ-মহাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন “ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙ্গালে—-, আমার এ ঘুম কেন ভাঙ্গালে। এশিয়ার বিখ্যাত কোকিল কণ্ঠ শিল্পী রুনা লায়লা গেয়েছেন- “আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা। এমনি শত শত গান রয়েছে এই পলাশ ফুল নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে উদ্ভিদের ফুল ধারনের সময়কালে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করছে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা।
শীতে শীর্ণতা কাটিয়ে নতুন প্রান এবং নব উদ্দীপনা নিয়ে আসে ঋতু রাজ বসন্ত। বাংলার শেষ ঋতু বসন্ত। এসময় বাংলার প্রকৃতি পুত্রপুস্পে সুশোভিত হয়ে উঠে। বনে বনে ফুলের সমারহ, আর দূর থেকে ভেসে আসে কোকিলের কুহুতান। পত্রহীন গাছে গজায় নতুন পাতা। পত্রপল্লবে শোভিত বৃক্ষশাখে ফুটে বিচিত্র ফুলের বাহার আম্রশাকে মুকুল দূল খায়। ঋতু প্রকৃতি সাজায় রাজকীয় চাকচিক্যে। এসময় অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি ফুলের বর্ণিল ছটায় প্রকৃতির বুকে রঙ্গের ছোয়া লাগে। জানা-অজানা ফুলের সুবাসে আকাশ-বাতাস মুখুর হয়ে উঠে। কবি বলেন “মহুয়া মালা গলে কে তুমি এলে/নয়ন ভুলানো রুপে কে তুমি এলে” এভাবেই বাংলার রুপের নায়ক বসন্ত বাংলা প্রকৃতিকে রুপ রসে ভরিয়ে তোলে।
পলাশ ফুলের নাম জানে না এমন লোক যেমন কম আছে, তেমনি পলাশ ফুল চিনেনা বা দেখেনি এমন লোকের সংখ্যায় বেশী। পলাশের আরেক নাম কিংশুক, ইংরেজী নাম ফ্লেম অব দ্যা ফরেষ্ট, বৈজ্ঞানিক নাম বুটিয়া মনোস্পার্মা । চমৎকার এই ফুলটি সম্পর্কে উদ্ভিদবীদ দ্বিজেন শর্মা “ফুলগুলি যেন কথা” বইতে লিখেছেন “মাঝারী আকারের পত্রমোচী দেশী গাছ। ৩টি পত্রিকা নিয়ে যৌগিকপত্র। ফুল ফুটে বসন্তের ৭.৫-১০ সেঃমিঃ শিম ফুলের মত, গাঢ় কমলা, লম্বা মুঞ্জুরীতে ঘনবদ্ধ থাকে। সারা গাছ ফুলে ফুলে ভরে উঠে। বীজ থেকে সহজেই চারা জন্মায়, বাড়েও দ্রুত।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা খান বাহাদুর ইসমাইল রোডের ব্রহ্মপুত্র নদের কুল ঘেষে গফরগাঁও সরকারি কলেজ। আর এই সরকারি কলেজের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক অনুপ সাদী ২০০৮সালের মাঝামাজি ঢাকা বৃক্ষ মেলা থেকে ৩০০ টাকায় ক্রয় করে সরকারি কলেজ মাঠে লাগিয়েছিলেন ২টি পলাশ ফুলের চারা। আজ সেটিতে এসেছে বসন্ত রাঙ্গা রুপ ও যৌবন। আগন্তক পথচারীরা আসা যাওয়ার সময় একবার হলেও তাকিয়ে দেখে পলাশ ফুলের দিকে। পলাশ ফুলের কাছে গিয়ে কথা হয় কলেজের অর্নাস ৩য় বর্ষের ছাত্রী পুষ্প আক্তারের সাথে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি কি ফুলের গাছ জানিনা। তবে এইটুকু বলতে পারি সাদি স্যার লাগিয়েছিলেন দুটি চারা। বিগত দিনে এরকম সুন্দর ফুল গাছ আমি দেখিনি। পলাশ ফুলে বসে শালিক, বউ কথা কও, কোকিল সহ বিভিন্ন পাখি লাফালাফি করে।
মূলত বসন্ত কালে গাছগুলি যখন তাদের পাতা হারিয়ে দৃষ্টিকোটতায় আক্রান্ত হয় তখনি প্রকৃতি তার আপন লীলায় মত্ত হয়ে দৃষ্টিকটু গাছে উজ্জল লাল বা গাঢ় কমলা রঙ্গের এই পলাশ ফুটিয়ে পলাশ গাছের আদর বাড়িয়ে দেয়। পাতাহীন গাছের প্রায় লেংটা ডালে যত্রতত্র ফুটতে দেখা যায় পলাশকে। তাইতো বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর পলাশকে দেখে লিখেছেন, “রাঙ্গা হাসি রাশি-রাশি অশোকে পলাশে, রাঙ্গা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙ্গা হিল্লোল।” পলাশের বিচি থেকে দেশীয় ভেজস ঔষুধ তৈরী করা হয়। একসময় পলাশ গাছের শিকড় দিয়ে মুজবুত দড়ি তৈরী করা হতো। সেই সাথে পলাশের পাতা দিয়ে তৈরী হতো থালা। আজও কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই পলাশ পাতার ছোট বাটিতে ফুসকা বা পানি পুরী বিক্রি করা হয় জানান প্রবীনরা।
ময়মনসিংহ মুমিনুনেসা সরকারি মহিলা কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক আলমগীর হোসেন সারোয়ার জনকণ্ঠকে বলেন,জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে উদ্ভিদের ফুল ধারনের সময়কালে বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা লক্ষ করছি । তিনি বলেন পলাশ ফুল ফোটার জন্য যে তাপমাত্রা প্রয়োজন সেই তাপমাত্রা এখনি আমাদের দেশে বৃদ্ধি পেতে শুরু করায় পরিবেশবিদরাও অনেকটা হতাশা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভরা মাঘে বা শীতে পলাশ ফোটার সময়কাল না একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এই অবস্থা। তিনি আরও বলেন, পলাশ ফুলের গাছ গোড়ায় বাকল ফাটা হলেও আকাঁবাঁকা শাখা প্রশাখা। বাকল মসৃণ বোটায় তিনটি করে পাতা থাকে। ফাগুনে গাছের পাতা ঝড়ে যায় তখনি আসে গাছে কুড়ি। আর কুড়ি থেকে ফুঠে সারা গাছে কমলা- লাল রঙ্গের ফুল ফুটে তখন সেই অগ্নিকান্তি রুপ দেখে মনে হয় আগুন লেগেছে। পলাশ ফুল ছোট ২ থেকে ৪ সেঃ মিঃ লম্বা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালোশিয়া ও পশ্চিম ইন্দোনিশিয়ার একটি প্রজাতি। তিনি আরও বলেন, পলাশ, কাঞ্চন, শিমুল বসন্তের প্রতীক। ভালবাসার প্রতীক, বসন্তের পাখিদের আকর্ষনীয় করে তোলে, মানুষকে প্রশান্তি দেয়। ইহা রঙের এক বিচিত্র আলপনা এরকম বৈচিত্রময় প্রকৃতি বাংলার বাইরে আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
নজরুল গীতিতে হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল, এনে দে এনে দে, নইলে রাধবোনা, বাঁধবোনা চুল। রক্ত লাল আগুনের শিখার মত জলজল করছে পলাশ ফুল গুলো। ডালে বসে আছে শালিক পাখি। হঠাৎ কানে এলো কোকিলের ডাক। আগুন লেগেছে বনে বনে’। কথাগুলো কানে এলে তক্ষুণি চোখে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠে মন পলাশকে দেখার জন্য । আর সেজন্যই বোধকরি ফুল প্রেমিরা বাংলার পলাশকে ডেকেছেন অরণ্যে অগ্নিশিখা। পলাশ শুধু এ কালে নয় সু-প্রাচীন কালেও ছিল সমান আদরনীয়। মহাভারতের সভা পূর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে উদ্যাম আর কৃত্রিম জলাধারের পাশেও ছিল পলাশ বৃক্ষের মাতামাতি। এমনকি ২ হাজারের বেশি বছর আগে লেখা কালিদাসের সংস্কৃত নাটক শকুনতলায় বর্ণিত প্রমোদ উদ্যানে পলাশের উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশে এক ঋতু চলে না যেতেই রুপের ডালি নিয়ে হাজির হয় আরেক ঋতু। কিন্ত এবারেই প্রথম ভরা মাঘে পলাশ দেখা মেলে।