প্রতি বছরই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বিপুলসংখ্যক হজযাত্রী। কিন্তু প্রতারক চক্রের সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। দৃশ্যমান কোনো শাস্তিরও নমুনা নেই। ফলে দিন দিন প্রতারণার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ওসব প্রতারককে পুলিশও খুঁজে পায় না। অথচ নিরীহ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে প্রতিবছর হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা ওই প্রতারকচক্র। প্রতিবছর হজযাত্রীরা প্রতারণার শিকার হলেও বলা হচ্ছে হজ চলাকালে প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হজ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। আর হজ শেষে অভিযোগ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় নামমাত্র শুনানি করে।
একই সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তারা এক মন্ত্রণালয়ে বেশিদিন থাকেন না। ফলে যে কর্মকর্তার সময়ে অনিয়ম হয়, পরে তিনি আর বিচার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। এতে কমে যায় অভিযোগের গুরুত্ব। ধর্ম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর নর্থ বেঙ্গল হজ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মোনাজ্জেম লুৎফর রহমান ফারুকী ২৬০ জন হজযাত্রীর কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা তুলে নিয়ে আত্মগোপন করেছেন। ধর্ম মন্ত্রণালয় এখনো লুৎফর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। অথচ মোনাজ্জেমই হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত এজেন্সির প্রতিনিধি। তাঁর বিরুদ্ধে বিগত ২০১৮ সালেও তিন শতাধিক হজযাত্রীর সঙ্গে প্রতারণার করে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আনা হয়। ওই সময় ফারুকীর দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। তার পরও তিনি হজ কার্যক্রম চালিয়ে প্রতিবছর হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা অব্যাহত রেখেছেন। এবার অন্যের এজেন্সি ব্যবহার করে হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণতা করেছেন। আর তার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তিনি নিয়মিত সৌদি আরবে যাতায়াত করছেন।
সূত্র জানায়, রংপুরের দিয়া ইন্টারন্যাশনালের মালিক লিড এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয় না করে ৭৫ জন হজযাত্রীর কাছ থেকে তিন কোটি টাকা নিজের এজেন্সির ব্যাংক হিসাবে নিয়েছেন। একইভাবে আল রিসান ট্রাভেলস এজেন্সি লিমিটেড ৪৪৮ জন হজযাত্রীকে নিবন্ধন করে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এসব কারণে দিয়া ইন্টারন্যাশনালের মোহাম্মদ আলী বাবু ও কামরুল ইসলাম এবং আল রিসান ট্রাভেলসের আবদুস সালাম মিয়ার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
তবে এখনো পুলিশ ও ধর্ম মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণাকারীদের কাউকে খুঁজে পায়নি। আর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, প্রতারণাকারী এজেন্সির বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক সময় বড় তদবির আসে। তখন ধর্ম মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে না। আবার অভিযোগকারী গ্রামের নিরীহ মানুষ হওয়ায় তাঁরা এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ করতে পারেন না।
সূত্র আরো জানায়, গত বছরও হজযাত্রায় ৫২৬ জন হজযাত্রী বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন। হজ প্যাকেজের পুরো টাকা জমা দিয়েও তাঁরা হজে যেতে পারছিলেন না। পরে প্রায় ৯ কোটি টাকা অতিরিক্ত দিয়ে হজ প্রশাসনের সহায়তায় সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল তাঁদের। যে দুটি হজ এজেন্সির মালিক ওই যাত্রীদের টাকা নিয়ে সটকে পড়েছিলেন তার মধ্যে এভিয়ানা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক খন্দকার শামসুল আলম ও এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক শাহ আলম রয়েছেন। হজ শেষে এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিকের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নেয়া হলেও এভিয়ানা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। ফলে প্রতারকচক্রের শাস্তি হয় না। এজন্য গত বছর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কিছু কর্মকর্তাকে বদলিও করা হয়েছিল। তবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সেই চক্রের কিছু সদস্য এখনো রয়ে গেছেন। ফলে এবারও এজেন্সি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে কৌশলে হজযাত্রীদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার জানান, এভিয়ানা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি আমরা। ফলে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। কারণ আইন অনুযায়ী লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।
অন্যদিকে এ বিষয়ে ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান জানান, এই মুহূর্তে প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে কঠিন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। কারণ, এখন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হজ ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হবে। হজ শেষে আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সব হজযাত্রীকে হজে নেয়ার চেষ্টা করছি আমরা।